মো. ফরহাদ উদ্দীন

জনগণের কাছে সমাজের নানা ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরার মাধ্যমে গণমাধ্যম ‘ওয়াচডগের’ ভূমিকা পালন করে। মানুষের জানার অধিকার বা আগ্রহ থেকে আমাদের সমাজে সংঘটিত নানা অপরাধ ও ত্রুটিবিচ্যুতি গণমাধ্যমে সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। মুক্ত গণমাধ্যম যে সমাজে বিদ্যমান, সেখানে অপরাধের নানা ঘটনা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে সংবাদ প্রকাশিত হয়ে আসছে। সমাজ বা রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির অপরাধ থেকে রাষ্ট্রীয় অপরাধ- সবই সংবাদের উপজীব্য হয়ে উঠতে পারে।


এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে খুন করলে তা যেমন সংবাদ হয় আবার রাষ্ট্রের প্রধান যদি কোনো অপরাধ করেন, সেটিও সংবাদ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ থেকে অনুধাবন করা যায়, রাষ্ট্র কিংবা সমাজের ওপর গণমাধ্যমের প্রভাব কতটা শক্তিশালী।


গণমাধ্যম-সমালোচকদের মতে, আমরা গণমাধ্যম থেকে যে সংবাদ পাই, এর বেশির ভাগই ‘অপরাধ’ সংক্রান্ত। সমাজে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। আকারে কোনোটি বড়ো আবার কোনোটি ছোটো। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা, গুপ্তহত্যা, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ- এগুলো অপরাধের একেকটি ধরন। এছাড়া ‘হোয়াইট কলার’ বা কায়িক শ্রমের কাজে নিযুক্ত নয়, এমন অপরাধ যেমন:- অর্থ আত্মসাৎ, ঘুস, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ইত্যাদি অপরাধও সমাজে বিদ্যমান। এসব অপরাধ নিয়ে সংবাদ হয় না- এমন দিন নেই বললেই চলে। গুরুত্বানুসারে অপরাধের ঘটনাগুলো পত্রিকার প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতায় সিঙ্গেল কলাম থেকে লিড নিউজ হিসেবে ছাপা হচ্ছে প্রতিদিন। ফলে ‘অপরাধবিষয়ক সাংবাদিকতা’ ধারণা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

সংবাদ উপাদান হিসেবে ‘অপরাধ’


যেসব উপাদান থাকলে একটি ঘটনাকে সংবাদ বলে গণ্য করা হয়, সেগুলোর মধ্যে ‘অপরাধ’ অন্যতম। বলা হয়ে থাকে, ‘‘Every bad news is good news and big news.’’ বিষয়টি কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশের মতো শোনালেও একজন সংবাদকর্মীর কাছে দুঃসংবাদ যত বড়ো হবে, সেটি তত ‘বড়ো সংবাদ’ এবং ‘ভালো সংবাদ’। আর এক্ষেত্রে অপরাধবিষয়ক সংবাদের গুরুত্বই আলাদা। তাছাড়া মনস্তাত্ত্বিক কারণেও অপরাধ ‘সংবাদের’ শক্তিশালী উপাদান হিসেবে কাজ করে। ‘সংবাদ রসায়ন’ নামে সংবাদিকতা পাঠের যে টার্মটি রয়েছে, সেটিতে বলা হয়েছে, কোনো সংবাদ ঘটনায় যৌনতা (সেক্স), অর্থ (মানি) ও অপরাধ একসঙ্গে বিদ্যমান থাকলে সেখানে সংবাদমূল্য গাণিতিক হারে (তিনটি উপাদানের মূল্য ১+১+১=৩ না হয়ে জ্যামিতিক হারে ১+২+৩=৬) নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ কোনো অপরাধ ঘটনার সঙ্গে যদি যৌনতা ও অর্থের সংশ্লেষ থাকে, তাহলে সেটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হিসেবে পরিগণিত হয়।

স্ট্যানলি ওয়াকারসহ অনেক সংবাদ বিশেষজ্ঞও 3Wকে (Women, Wampum and Wrong-doing) সংবাদ রসায়নের কার্যকর উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অপরাধ সংবাদ রসায়নের মাধ্যমে সংবাদের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। ফলে পাঠক-শ্রোতা সংবাদটি পড়তে বা দেখতে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে।

নানা কারণে মানুষ অপরাধ প্রতিবেদন পড়তে বা শুনতে চায়। কী কারণে অপরাধ সংঘটিত হয়, এ সম্পর্কে পাঠক জানতে চায়। সমাজে সংঘটিত অপরাধটি তার ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে কি না, এ সম্পর্কে গণমাধ্যম থেকে ব্যাখ্যা চায় তারা। প্রতিবেদন থেকে তথ্য পেয়ে তারা অপরাধটি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার চেষ্টা করে। কীভাবে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ করা যায়, এ সম্পর্কে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে ধারণা লাভ করার চেষ্টা করে। সমাজের বেশির ভাগ মানুষ আইন মেনে চলে। কেউ যদি আইন ভেঙে কোনো অপরাধ করে, সেটি কেন করেছে এবং এর কী শাস্তি হচ্ছে, আদৌ শাস্তি হচ্ছে কি না, তা জানার আগ্রহ থেকে অপরাধ প্রতিবেদন করা হয়। দেশে আইনের শাসন বজায় আছে কি না, তা মানুষ গণমাধ্যম থেকে বুঝতে চেষ্টা করে।

সংবাদের অন্যান্য উপাদানের মতো অপরাধের ঘটনাটি নতুন, অস্বাভাবিক, তাৎপর্যপূর্ণ হলে তা আকর্ষণীয় সংবাদে রূপ নেয়। সংবাদ হওয়ার জন্য অপরাধটি আপডেট হতে হয়। কারণ সমাজে একই ধরনের ঘটনা প্রতিদিন সংঘটিত হচ্ছে। ফলে একটি ঘটনা ছাপিয়ে আরেকটি ঘটনা আসে এবং সংবাদপত্রে জায়গা করে নেয়। ধরা যাক, একটি স্থানে শনিবার একজনকে খুন করা হয়েছে। এই ঘটনাটি যদি ওইদিনই নিউজ করা না হয়, তাহলে পরের দিন সেটি নিউজ না-ও হতে পারে। কারণ পরের দিন অন্যস্থানে আরও খুনের ঘটনা ঘটতে পারে এবং স্বাভাবিকভাবে সংবাদের তাৎক্ষণিকতা বিচারে আগের দিনের ঘটনাকে ছাপিয়ে পরের দিনের ঘটনা পত্রিকায় জায়গা করে নেবে। তাই অপরাধ যেদিন সংঘটিত হয়েছে, ওইদিনই পরিপূর্ণ তথ্যসহ সংবাদ উপস্থাপন করার জন্য সাংবাদিকদের চেষ্টা করতে হবে। তবে কিছু সংবাদ আছে যেগুলো সময়ের মাপকাঠিতে মাপা যায় না। অপরাধের ধরন যদি ভয়াবহ ও বড়ো আকারের হয় এবং সমাজে যদি এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকে, তাহলে সেই অপরাধ সব সময় সংবাদ হওয়ার দাবি রাখে।

সাংবাদিকতায় ‘অপরাধ বা ক্রাইম’ বিট


কার্যকর সংবাদমূল্য নিহিত থাকার কারণে সাংবাদিকতায় ‘অপরাধ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘বিট’ বা ‘সংবাদবিষয়’ হিসেবে স্বীকৃত। অপরাধবিষয়ক সাংবাদিকতায় আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা অপরাধের ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়। অপরাধের কারণ, প্রকৃতি, মাত্রা ও সমাজে এর প্রভাব সম্পর্কে উপস্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে নানা অপরাধচক্র সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার প্রচেষ্টা করা হয়।


প্রত্যেক পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলে ‘ক্রাইম বিটের’ সাংবাদিকরা অপরাধের ঘটনাগুলোর সংবাদ সংগ্রহ করেন। সমাজের বড়ো অপরাধের ঘটনাগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরতে প্রথম সারির পত্রিকাগুলোয় বিশেষায়িত টিমও কাজ করে থাকে। আবার অনেক টিভি চ্যানেলে অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয় আলাদা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। ইনডিপেনডেন্ট টিভির ‘তালাশ’, যমুনা টিভির ‘ইনভেস্টিগেশন ৩৬০ ডিগ্রি’, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ‘সার্চলাইট’ প্রোগ্রামে আমাদের সমাজে সংঘটিত নানা অপরাধের ঘটনার পেছনের ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। যে কারণে এসব প্রোগ্রামের জনপ্রিয়তাও তুলনামূলকভাবে বেশি।
এই বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের তুলনামূলকভাবে বেশি পরিশ্রম করতে হয়। কারণ একটি দুর্ঘটনা বা অপরাধ রাত বা দিনের যে কোনো সময়ে সংঘটিত হতে পারে। ছিনতাই, খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধের ঘটনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাতে সংঘটিত হয়। তাই এই বিটের সাংবাদিকদের ২৪ ঘণ্টার যে কোনো সময়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে প্রস্তুত থাকতে হয়। আবার অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনাগুলো অন্য বিটের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট হতে পারে। এ ক্ষেত্রেও অপরাধ বিটে কর্মরত সাংবাদিককে ঘটনার তীব্রতা বুঝে ওই সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়। অনেক সময় বিভিন্ন জেলায় গিয়েও তাদের সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়। কারণ কোনো জেলায় সংঘটিত ঘটনাটি যদি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়, তাহলে সেই ঘটনার কাভারেজ ভালো হওয়ার জন্য সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল থেকে টিম পাঠিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করা হয়। সম্প্রতি সংঘটিত বরগুনায় এক যুবককে কুপিয়ে হত্যার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সেই ঘটনার আদ্যোপান্ত তুলে ধরতে প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলো অপরাধ বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের সেখানে পাঠায়। তারা সেই ঘটনার নানা ধরনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ক্রাইম রিপোর্ট বা অপরাধ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে করণীয়


অপরাধ সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে তুলনামূলকভাবে একজন সাংবাদিককে বেশি সতর্ক থাকতে হয়। কারণ প্রতিবেদনে অসাবধানতাবশত ভুল কোনো তথ্য ছাপা হলে তা অন্যের জন্য বড়ো ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। যদি কোনো সংবাদে অপরাধের সঙ্গে জড়িত নয়, এমন কোনো ব্যক্তির নাম প্রকাশিত হয়, তাহলে ওই ব্যক্তি সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি সংবাদটি যদি কোনো হত্যাকাণ্ড বা বড়ো ধরনের অপরাধ হয়, তাহলে ওই ব্যক্তি পুলিশের হয়রানির শিকার হতে পারে। এমনকি প্রতিবেদনে নাম, বয়স, পদবি, পরিচয় লেখার সময় ভুল করা হলে তা অন্যের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। কারণ অপরাধ সংক্রান্ত সংবাদ বিভিন্ন তদন্ত কাজে ডকুমেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই এ ধরনের সংবাদ লেখার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
প্রত্যেকটি সংবাদেরই সোর্স বা সূত্র থাকে। আবার নির্দিষ্ট উৎস বা স্থান থেকেও সংবাদ সংগ্রহ করা যায়।

অপরাধবিষয়ক সংবাদেরও নির্দিষ্ট কিছু সংবাদসূত্র বা উৎস থাকে। যেমন কোনো খুনের ঘটনা ঘটলে হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তির পরিবার বা প্রত্যক্ষদর্শী সংবাদের সোর্স হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। আবার পুলিশ স্টেশন বা হাসপাতাল হতে পারে সেই সংবাদের উৎস। এ ধরনের সংবাদ লেখার সময় একজন সাংবাদিককে তথ্য সংগ্রহে একাধিক সোর্স থেকে তা নিশ্চিত করা উচিত। বিশেষ করে ঘটনা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী, পুলিশ, হাসপাতালসহ অন্যান্য সোর্স থেকে প্রাপ্ত তথ্যের মিল আছে কি না, তা ক্রস চেক করে নিতে হবে। তথ্যের কোথাও অস্পষ্টতা বা সংশয় থাকলে প্রতিবেদককে অবশ্যই তা দূর করতে হবে। যদি কোনো তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা না যায় তবে সেই তথ্য পরিহার করেই প্রতিবেদন সম্পন্ন করতে হবে। প্রতিবেদনে অসত্য বা অর্ধসত্য কোনো তথ্য দেওয়ার সুযোগ নেই। প্রতিবেদনের তথ্য হবে শতভাগ সত্য।


কোনো সোর্স যদি তার পরিচয় গোপন রাখতে চায়, তাহলে প্রতিবেদনে তার পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। সংবাদের সোর্সকে বিপদে ফেলার অধিকার সাংবাদিকের নেই। সোর্সকে রক্ষা করতে সাংবাদিক জেলে গেছেনÑ এমন ঘটনাও রয়েছে। তবে আদালতে বিচারের ক্ষেত্রে জনস্বার্থে সংবাদের সোর্সের পরিচয় প্রকাশ করা যেতে পারে, যদিও তা বাধ্যতামূলক নয়। প্রতিবেদনে অজ্ঞাতনামা বা নামপরিচয়হীন কোনো সোর্স ব্যবহার করা যাবে না। প্রতিবেদকের সময় স্বল্পতা বা অন্য কোনো কারণে কোনোভাবেই বেনামি সোর্স সংবাদে ব্যবহার করা যাবে না। অফ দ্য রেকর্ড, জানা গেছে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ^স্ত সূত্র, সংশ্লিষ্ট সূত্র, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, বিশেষজ্ঞদের ধারণা, অভিজ্ঞ মহল, ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, অনেকের মতে, অনেকে মনে করেন, সচেতন লোকজন মনে করেন, এলাকাবাসীর মতে, ইত্যাদি অজ্ঞাত সোর্স সংবাদে ব্যবহার করলে সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা হারায়।


‘অপরাধবিষয়ক সাংবাদিকতায়’ সাংবাদিকদের সারফেস রিপোর্টিং বা উপরিতল প্রতিবেদনের চেয়ে ডেপথ রিপোর্টিং বা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ফলে একটি অপরাধের ঘটনা ঘটলে সেটি গণমাধ্যমের আগেই ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যমের সুবাদে জনগণের কাছে দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে। তাই শুধু কী ঘটেছে, তা যদি সংবাদে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে পাঠকের কাছে সেই সংবাদ মূল্যহীন বরং কেন ঘটেছে, সমাজে এই ঘটনার প্রভাব কীÑ এসব বিষয়ে পাঠক জানতে চায়। তাছাড়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার সাদামাটা বর্ণনা পরিহার করে ভিন্নরূপে তথ্যবহুলভাবে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা উচিত। একটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা জানানোর চেয়ে হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করে তা পাঠকের সামনে তুলে ধরে সচেতনতা বৃদ্ধি করাই সমাজের প্রতি সাংবাদিকদের প্রকৃত দায়বদ্ধতা।

সাংবাদিকতার নীতিমালা যেন উপেক্ষিত না হয়


সমাজের ওপর সংবাদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তাই সংবাদ পরিবেশনে সাংবাদিকদের নৈতিক ও সামাজিক অঙ্গীকার থাকা বাঞ্ছনীয়। বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও পূর্ণ সত্য প্রকাশ করা প্রত্যেক সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব। সারা বিশে^ সাংবাদিকতা পেশায় বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা, যথার্থতা, শালীনতাবোধসহ কিছু নীতিমালা মেনে চলা হয়। অপরাধ প্রতিবেদন তৈরির সময় এসব বিষয় উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সংবাদপত্রের সার্কুলেশন বা টিভি চ্যানেলের টিআরপি (টেলিভিশন রিডিং পয়েন্ট) বাড়াতে অনেক সময় অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনাগুলোকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ঘটনাকে চাঞ্চল্যকরভাবে উপস্থাপন করে পাঠক ও দর্শকশ্রোতার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করার এই প্রবণতাকে আমরা ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ বলে অভিহিত করি। সাম্প্রতিক সময়ে হাজার হাজার ভুঁইফোঁড় অনলাইনে এ ধরনের হলুদ সাংবাদিকতার চর্চা বেশি পরিলক্ষিত হয়।


আমরা বিভিন্ন সময় লক্ষ করি, খুনের ঘটনা আদালতে প্রমাণ হওয়ার আগেই প্রতিবেদনে একজনকে খুনি বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ‘অমুক খুন, খুনি গ্রেফতার’- এমন সংবাদ শিরোনাম হরহামেশাই হচ্ছে। আত্মহত্যা না পরিকল্পিত হত্যা, তা প্রমাণ হওয়ার আগেই প্রতিবেদনে লেখা হয় ‘অমুকের আত্মহত্যা’। ইচ্ছাকৃত বা অসাবধানতাবশত অপরাধবিষয়ক সংবাদে এ ধরনের ভুল করার সুযোগ নেই। কারণ এটি একধরনের ‘মিডিয়া ট্রায়াল’। মিডিয়া বা গণমাধ্যম ঘটনার বিবরণ পাঠকের কাছে তুলে ধরবে আর ট্রায়াল বা বিচার করবেন আদালত। আদালতে অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। আবার কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কোনো সাংবাদিকের নেই। প্রতিবেদন তৈরির সময় সাংবাদিককে ব্যক্তির ব্যক্তিগত অধিকারের সেই সীমারেখা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে সংবাদে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা সাংবাদিকতার নীতিবহির্ভূত।


এই ধরনের সংবাদে অনেক সময় অপরাধী বা দোষী ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনকেও হেয়প্রতিপন্ন করা হয়, যা সম্পূর্ণ নীতিবহির্ভূত। একটি প্রথম সারির দৈনিকে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে পড়েছিলাম অপরাধীর নামের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ‘অমুক তার দুলাভাই’। কিন্তু প্রতিবেদনে বা অপরাধের সঙ্গে অপরাধীর দুলাভাইয়ের কোনো সম্পর্ক ছিল না। অসতর্কতাবশত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে- যেভাবেই হোক না কেন, ওই নামটি ব্যবহার করার মাধ্যমে প্রতিবেদনে ওই ব্যক্তির ‘মানহানি’ করা হয়েছে। এ ধরনের প্রতিবেদনে অবশ্যই মানহানিকর মন্তব্য থেকে সাংবাদিকদের বিরত থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে অযথা নিন্দামূলক কিছু প্রতিবেদনে লেখা যাবে না। অভিযুক্ত বা অপরাধীর আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবের সম্মানে আঘাত করে বা তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেÑ এমন জনস্বার্থহীন অহেতুক কোনো তথ্য সংবাদে পরিবেশন করা উচিত নয়। দণ্ডবিধি ৪৯৯-৫০২ ধারায় মানহানি সম্পর্কিত আইনের বিধান রয়েছে। ৫০০ ধারা অনুযায়ী কারও বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগ প্রমাণিত হলে দুই বছরের বিনাশ্রম বা অর্থদণ্ড বা উভয়বিধ দণ্ডে শাস্তির বিধান রয়েছে।


অনেক সময় টিভি চ্যানেলে লাশের ছবি কিংবা ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ছবি দেখানো হয়। বিশেষ করে লাইভ প্রচারের সময় ঘটনার তীব্রতা তুলে ধরতে গিয়ে আহতদের রক্তাক্ত ছবি দেখানো হয়। গণমাধ্যমে লাশের ছবি বা রক্তাক্ত ব্যক্তির ছবি বা ফুটেজ প্রচার বা প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই।


ধর্ষণের ঘটনায় সংবাদ করতে গিয়ে অনেক সময় ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি বা ভুক্তভোগীর নাম তুলে ধরা হয়, যা সাংবাদিকতার নীতিবহির্ভূত। সংবাদে কোনোভাবে ভুক্তভোগীর নাম, ঠিকানা বা পরিচয় দেওয়া যাবে না। কারণ ভুক্তভোগীর নাম-পরিচয় যদি সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে ওই ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়। অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদনে অবশ্যই অভিযুক্তের বক্তব্য থাকতে হবে। কারণ যাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। যদি তা করা না হয়, তাহলে সংবাদটি বস্তুনিষ্ঠতা হারাবে।

তথ্যসূত্র
 Harris, Julian et. al. (1985), The Complete Reporter (5th edition), Mcmillan Publishing Company, New York
 Fletcher, Kim (2005), The Journalist’s Handbook, Macmillan, London
 Crime Reporting Manual, Chapter 35: crime reporting introduction retrieved
 রহমান, অলিউর (২০০৭), সাংবাদিকতা: ধারণা ও কৌশল, শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা

লেখক: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ^বিদ্যালয়

শেয়ার করুনঃ

এখানেই থেমে যাওয়া নয়

আরও যা পড়তে পারেন

বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টিভির চ্যালেঞ্জ, সমস্যা ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশে দুই দশক ধরে গণমাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি ও সংবাদকর্মীদের মধ্যে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

ক্রীড়া সাংবাদিকতার সেকাল-একাল

দ্দূর জানা যায় বা গুগল-উইকিপিডিয়া ঘেঁটে দেখা যায়, ছাপার অক্ষরে প্রথম দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় সতেরো শতকের শেষদিকে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা: সাংবাদিকতার সুযোগ

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সাংবাদিকতায় পরিবর্তন দৃশ্যমান। দুই দশক আগে স্বাস্থ্য নিয়ে যে পরিমাণ সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেত, এখন তার চেয়ে বেশি সংবাদ প্রচারিত হয়।

সাংবাদিকতায়
হাতে-খড়ি হোক
পিআইবির সাথে

সাংবাদিকতা বিষয়ে ই-লার্নি  কোর্স করতে নিচের বাটনে ক্লিক করুন। বিস্তারিত জানতে ই-মেইল করুন support@pibelearning.gov.bd ঠিকানায়