মানসিক স্বাস্থ্য ও গণমাধ্যম

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান খান

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে জনগণের তথ্য পাওয়ার প্রাথমিক-মুখ্য উৎস হচ্ছে সংবাদমাধ্যম এবং মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে সংবাদমাধ্যম মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও অপবাদমূলক মানসিকতাকে পরিবর্তন করতে জোরাল ভূমিকা রাখে। মানসিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণে মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরিতেও সংবাদমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখে গেছে, তাদের দেশের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে তথ্য পায় টেলিভিশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে, শতকরা ৫৮ জন পায় সংবাদপত্রের মাধ্যমে; ৩৪ জন ম্যাগাজিন এবং ২৫ ভাগ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে তথ্য পায় ইন্টারনেট থেকে।

প্রকৃতপক্ষে, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে উল্লিখিত মাধ্যমগুলোই হচ্ছে আমাদের তথ্যসমৃদ্ধ হওয়ার উপায়। আর এসব মাধ্যমে তথ্য সংগ্রাহকের ভূমিকায় আছেন আমাদের সংবাদকর্মীরা। উপরিউক্ত পরিসংখ্যান আমাদের দেশের ক্ষেত্রে হুবহু প্রযোজ্য না হলেও ধারণা হিসেবে নেওয়া যেতে পারে যে, বিশে^র প্রায় অনেক দেশের মতো আমাদের জনগোষ্ঠীর একটা বড়ো অংশও টেলিভিশন প্রোগ্রাম, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও ইন্টারনেট থেকেই সব ধরনের তথ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়েও তথ্য পেয়ে থাকেন। আজকের আলোচনার অবতারণা কেবল মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি এবং এর চিকিৎসাসেবার প্রমোশনে সংবাদকর্মী বা সংবাদপত্রের ভূমিকা বিষয়ে।

সাধারণত আমরা দেখে থাকি, কোনো সংবাদপত্রের পাতায় কিংবা রেডিও-টেলিভিশনে একজন সাংবাদিক বা উপস্থাপক সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞকে কিছু প্রশ্ন করে থাকেন যেগুলোর উত্তর তিনি দিয়ে থাকেন। এতে সাধারণ মানুষ যে তথ্যগুলো পায়, তা থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছু শেখা যায় ঠিকই তবে সেটুকু পর্যাপ্ত নয়। কারণ হিসেবে বলা যায়, ছকবদ্ধ কিছু বিষয়ের ওপর আলোকপাত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য করে তুলতে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগের উপযোগী করে পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখতে পারে না। বিশেষত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আচরণ পরিবর্তন খুবই দুরূহ। এক্ষেত্রে একটি মানসিক রোগের শুরু, লক্ষণ, বিস্তারিত কারণ, এর স্বল্পমেয়াদি ও সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকারক দিক, দৈনন্দিন জীবনযাপনে এর প্রভাব, ব্যক্তির কর্মক্ষমতা ও কর্মদক্ষতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব, পরিবারের সদস্য অথবা তার কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে পেশাগত যোগাযোগ রক্ষাসহ নানাবিধ বিষয় জড়িত রয়েছে। আবার একই রোগের ক্ষেত্রে এগুলো ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়।

সময়স্বল্পতা কিংবা লেখার সাইজ-আকারের সীমাবদ্ধতা অথবা দর্শক-পাঠকের অনুষ্ঠান দেখা বা প্রকাশিত লেখাটি পড়ার ধৈর্যও এক্ষেত্রে একটি বড়ো বাধা হলেও এগুলোর উত্তরণ খুবই জরুরি। সেজন্য দরকার যে কোনো একটি বিষয় নিয়ে খুব বিশদভাবে, প্রয়োজনে অল্প পরিমাণে ইতিবাচক ও ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন। ‘ইতিবাচকভাবে’ শব্দটি এ কারণেই বললাম, উপর্যুক্ত তথ্যসূত্র মতে, সাধারণত গণমাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক উপস্থাপনাগুলো নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হয়। ফলে সাধারণ মানুষ, এসব রোগে ভুগছেন- এমন মানুষ, এমনকি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের মধ্যেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টির প্রতি একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হন আমাদের রোগীরা। ভোগান্তিতে পড়েন তাদের আত্মীয়স্বজন। কারণ তখন রোগী তাদের চিকিৎসাটি নিতে ভয় পান এবং আত্মীয়স্বজনও তাদেরকে চিকিৎসা গ্রহণ করাতে রাজি করতে বা চিকিৎসকদের কাছে আনতে পারেন না। তাই সংবাদ সংগ্রাহক পেশাজীবী সুধীজনদের উদ্দেশে বলছি, কোনো রোগের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে বিস্তারিত, ধারাবাহিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিবাচক তথ্য পরিবেশন করুন। 

মানসিক সমস্যার চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে পৃথিবীজুড়েই অপবাদ কিংবা বৈষম্যের চর্চা লক্ষণীয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। মানসিক সমস্যার চিকিৎসা গ্রহণের প্রবণতা সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের গবেষণামূলক প্রবন্ধ এবং দীর্ঘদিনের মানসিক সমস্যার চিকিৎসাচর্চার অভিজ্ঞতা থেকে এ কথাটি স্পষ্টই বলা যায় যে, আমাদের দেশের অনেক মানসিক সমস্যাগ্রস্ত মানুষ মানসিক সমস্যার চিকিৎসা নিতে আসেন না কেবল অপবাদ বা বৈষম্যের শিকার হবেন বলেই। পাছে তাদের ভয় থেকেই যায় যে, ‘যদি সবাই আমাকে পাগল মনে করে।’ সবচেয়ে বেশি দুঃখজনক এটি যে, আশপাশের মানুষ এ নিয়ে যতখানি আতঙ্ক তৈরি করে, তার চেয়ে বেশি আতঙ্কগ্রস্ত থাকেন মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকা মানুষটির পরিবারের সদস্যরা। নিজ সন্তানের ক্ষেত্রে মা-বাবাও এর ব্যতিক্রম নন। আর এ ধরনের অপবাদমূলক চর্চার কারণে দেশের অনেক মানসিক রোগীই মানসিক সমস্যার চিকিৎসা গ্রহণে ভয় পান। ফলে মৃদুমানের মানসিক সমস্যাগ্রস্তদের মানসিক সমস্যার তীব্রতা বেড়ে যায় বহুগুণ।

শুরুর দিকে মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা গ্রহণ করলে শুধু কয়েকটি কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি সেশনের মাধ্যমে এবং ওষুধ ছাড়াই যেমন চিকিৎসা করলে রোগী ভালো হয়ে যেতে পারত, সেখানে তখন বিষয়টি আরও জটিল হয়ে যায়। ফলে ভোগান্তি বাড়ে রোগীর নিজের, তার পরিবারের সদস্যদের। এমনকি চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়ে যায় বহুগুণে। অতএব অপবাদ বা বৈষম্য দূরীকরণে এক্ষেত্রে বাবা-মা, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, আত্মীয়স্বজন এবং সমাজের প্রতিটি মানুষের সচেতন জরুরি। আর এ ধরনের সচেতনতামূলক জ্ঞান সহজেই অর্জন সম্ভব মিডিয়ার বদৌলতে। বেশি বেশি এবং নিয়মিত প্রকাশনা এ ধরনের অপবাদজনিত কুসংস্কার থেকে আমাদেরকে বের হতে সাহায্য করবে এবং ভুল বোঝাবুঝির ক্ষেত্রটিকে দুর্বল করে দেবে। একইভাবে অপবাদজনিত কুসংস্কারের সঙ্গে আমাদের মানসিক প্রস্তুতিকে সহজীকরণের একটি অবস্থা তৈরি করবে।

অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যায়, অপবাদমূলক এবং নেতিবাচক তথ্য মানসিক সমস্যার চিকিৎসা গ্রহণের উৎসাহকে বাধাগ্রস্ত করে। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত থাকায় রোগীর কোনো বিরূপ আচরণ যেমন- কাউকে আঘাত করা, আগ্রাসী আচরণ করা, কাউকে খুন করা- এসব খবর বেশি প্রচার পেলে এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অন্য মানসিক রোগীদের মধ্যে, এমনকি সমাজেও। গবেষণায় দেখা গেছে, বিনা অপবাদমূলক লেখনী বা তথ্যের প্রচার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এজন্য ইতিবাচক সংবাদতথ্য পরিবেশনা মানসিক স্বাস্থ্য-সমস্যা সমাধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

অনেকেই আবার জানেন না যে, কোন অবস্থায় মানসিক সমস্যার চিকিৎসা গ্রহণ প্রয়োজন? কোন ধরনের মানসিক সমস্যার জন্য কী ধরনের চিকিৎসা গ্রহণ প্রয়োজন? কোথায় গেলে মানসিক সমস্যা সমাধানে চিকিৎসা পাওয়া যাবে? এসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তরও জানা সম্ভব সাংবাদিকদের নিয়মিত লেখনীর মাধ্যমে। অতএব মানসিক সমস্যার সুস্থতায় সংবাদপত্রের অবদান অপরিসীম। এবার একটু বুঝতে চেষ্টা করি যে, ‘কখন বুঝব আমি মানসিকভাবে অসুস্থ এবং আমার চিকিৎসা নেওয়া দরকার? কোথায় এবং কাদের কাছে চিকিৎসা নেব? কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপির প্রক্রিয়াগুলো কী বা কেমন?’

প্রতিটি মানুষই কিছু না কিছু কাজের মাধ্যমে উপার্জন করে নিজে এবং পরিবারের সদস্যদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। কর্মজীবী মানুষের ক্ষেত্রে নিয়মিত কাজ করে উপার্জনের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি প্রযোজ্য। ধরি, একজন ছাত্র কোনো উপার্জন করে না। এক্ষেত্রে নিয়মিত পড়াশোনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত উপস্থিত থাকা, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা ইত্যাদি হচ্ছে তার দৈনন্দিন কাজের অংশ। দৈনন্দিন জীবনযাপনে একজন মানুষ বিভিন্ন সময়ে নানা মানসিক টানাপোড়েনে ভুগে থাকেন। যেমন- মন খারাপ থাকা, ঘন ঘন রাগ হওয়া, বিষাদগ্রস্ততা, হতাশা, আতঙ্ক বা ভয় ইত্যাদি আরও নানা কারণে এগুলো হয়ে থাকে। এসবের প্রায় অধিকাংশই সাধারণত একজন মানুষের বিভিন্ন ধরনের মানসিক বা আবেগীয় সংকটের কারণে হয়। আর এসব কারণে তার দৈনন্দিন কাজকর্মগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়; তার খাওয়াদাওয়া, ঘুম, তার পরিবারের সদস্য অথবা আশপাশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেতে পারে। সহজ কথায় বলা যায়, শারীরিক সমস্যার বাইরে মানসিক বা আবেগের কারণে একজন ব্যক্তির করণীয় দৈনন্দিন কাজকর্ম যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন বোঝা দরকার যে উনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, এক বা দুই দিন এ সমস্যাগুলো হলেই যে সে মানসিকভাবে অসুস্থ এবং তাকে চিকিৎসা নিতে হবে- এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। যেমন- বিষণ্নতা রোগের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, একজন ব্যক্তির মধ্যে ১৩টি লক্ষণের মধ্যে কমপক্ষে ৫টি লক্ষণ দুই সপ্তাহ বা তার অধিক সময় থাকলে তার বিষণ্নতা রোগ আছে বলে ধরা হয়ে থাকে। তবে বিষণ্নতা রোগেরও অনেক ধরন রয়েছে। সুতরাং কেউ যদি নিজের ক্ষেত্রে উপরিউক্ত একাধিক লক্ষণ বিবেচনা করেন এবং বিশেষত তার দৈনন্দিন কাজকর্মের ক্ষতি বা উৎপাদনশীলতা হ্রাসের অবস্থা বিবেচনা করেন, তাহলে তার অবশ্যই একজন মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ এখানে মূল কথাটি হচ্ছে- মানসিক বা আবেগের কারণে যখন একজন মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম একটি নির্দিষ্ট সময় অবধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখনই তার মানসিক চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। তবে মানসিক চিকিৎসা গ্রহণের এই ধাপে এটি বোঝা খুব দরকার যে, মানসিক চিকিৎসকদের আবার দুইটি ডিসিপ্লিন রয়েছে। একটি হচ্ছে মনোচিকিৎসক বা সাইকিয়াট্রিস্ট; আরেকটি হচ্ছে চিকিৎসা মনোবৈজ্ঞানিক বা মনোবৈজ্ঞানিক ডিসিপ্লিন। মনোচিকিৎসক বা সাইকিয়াট্রিস্টরা মানসিক রোগ সমাধানের জন্য সাধারণত ওষুধ প্রয়োগ করে থাকেন এবং পাশাপাশি কিছু সময়ের জন্য কাউন্সেলিং করে থাকেন। ওনারা মেডিকেল ব্যাকগ্রাউন্ডের এবং ওষুধ প্রেসক্রাইব করার জন্য মনোনীত ব্যক্তি। আর চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী (ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট) বা সহকারী চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী অথবা সাধারণ মনোবিজ্ঞানীরা ওষুধ প্রেসক্রাইব করার জন্য মনোনীত ব্যক্তি নন এবং ওনারা মানসিক রোগের চিকিৎসা প্রদানে সাইকোথেরাপি প্রয়োগ করে থাকেন।

সাইকোথেরাপি হচ্ছে মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধরনের তত্ত্ব ও মতবাদ (থিওরি ও প্রিন্সিপাল) প্রয়োগ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মনোরোগের প্রকৃতি, লক্ষণ, কারণ অনুসন্ধান করে সমাধানের এক ধরনের প্রক্রিয়া, যা সাধারণত কথা বলার মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়ার একটি আদর্শ মানদণ্ড হচ্ছে-একজন থেরাপিস্ট বা চিকিৎসক একজন রোগীর (তবে সাইকোথেরাপি চিকিৎসাসেবায় চিকিৎসাপ্রার্থীকে সাধারণত রোগী বলা হয় না, ক্লায়েন্ট বলা হয়ে থাকে) সঙ্গে সপ্তাহে একদিন ৫০ মিনিটের একটি আলোচনায় বসেন, যেটিকে একটি সেশন বলা হয়। সাধারণত ৮-১২টি সেশনের মধ্যে একজন ক্লায়েন্টের সুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে রোগের তীব্রতার মাত্রানুযায়ী কখনো কখনো এর বেশি সেশনেরও প্রয়োজন হতে পারে।

মনে রাখা প্রয়োজন, সেশনগুলো নিয়মিতভাবে প্রতি সপ্তাহে নিতে হবে। তাহলে সর্বোচ্চ কার্যকারিতা পাওয়া যাবে। কথা হচ্ছে- দেশব্যাপী চিকিৎসাব্যবস্থা ঢাকামুখী হওয়ায় যারা সাধারণত ঢাকা বা এর আশপাশে থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে সাপ্তাহিকভাবে নিয়মিত সেশন নেওয়া সম্ভব হতে পারে। প্রশ্ন হলো- যারা ঢাকার বাইরে বা দূর-দূরান্ত থেকে আসবেন, তারা কী করবেন? এক্ষেত্রেও বলব, সপ্তাহে একদিন বাঞ্ছনীয়; কিন্তু তা না পারলে অবশ্যই দুই সপ্তাহ অন্তর একটি সেশন নিতে হবে। এবার আসি, রোগী না বলে ক্লায়েন্ট কেন বলা হয়? এর কারণ হচ্ছে- শারীরিক রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে রোগীর কোনো দায়িত্ব থাকে না। কারণ রোগী কোনোভাবে ওষুধ খেলেই হলো। ওষুধ নিজস্ব গতিতে কাজ করবে। সাইকোথেরাপিতে এমনকি চিকিৎসার প্রয়োজনে ওষুধ লাগলেও একজন মানুষকে নিজ দায়িত্বে ভালো থাকার জন্য চর্চা করতে হয়। মনে রাখবেন, সাইকোথেরাপিস্ট একজন মানুষকে কেবল ভালো থাকার জন্য তাকে কিছু কৌশল শিখিয়ে দেন। সেই কৌশলগুলো রপ্ত করে, সেগুলোকে প্রতিনিয়ত চর্চা করেই একজন মানুষকে ভালো থাকতে হয়। অর্থাৎ চিকিৎসাপ্রত্যাশী মানুষটিকে নিজের দায়িত্ব নিতে হয়। এ কারণেই সাইকোথেরাপি বা চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় একজন চিকিৎসাপ্রত্যাশী মানুষকে রোগী না বলে ক্লায়েন্ট বলা হয়। সুতরাং যারাই সাইকোথেরাপি চিকিৎসা নিতে আসবেন, তারা নিজেরা কিছুটা প্রস্তুত হয়ে আসবেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা এমন কাউকে নিয়ে আসেন যাদের মধ্যে সেই ইচ্ছাশক্তির বালাইটুকুও থাকে না। এমন ক্ষেত্রে থেরাপিস্টরা ক্লায়েন্টের মধ্যকার ইচ্ছাশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে কাজ করেন, যাতে ক্লায়েন্ট সেশনগুলোয় নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং চিকিৎসাকে কার্যকর করতে সক্রিয় হন। সাইকোথেরাপির একটি বড়ো শক্তি হলো এটি পরিপূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক বা বিজ্ঞানসম্মত পথ মেনে চলে। কেউ যদি সাইকোথেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতি পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসরণ করে চলে এবং তার দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করে, তাহলে সে সারা জীবনের জন্য ভালো থাকতে বাধ্য।

এই তো গেল সংক্ষেপে মানসিক স্বাস্থ্য ও এর চিকিৎসা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার কিছু নমুনা। এসবের পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে জড়িত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে স্কেল আপ করা, পারস্পরিক যোগাযোগ ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; হেলথ কেয়ার সিস্টেম ও পলিসি তৈরিকারক এবং বিজ্ঞজনদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে সেতুবন্ধ তৈরি করা; মানবাধিকারকে আরও জোরালোকরণসহ অনেক কার্যক্রম আছে যেগুলোর মূল ধরে ঘুণ সরানোর বিষয়ে সংবাদপত্র গভীরভাবে কাজ করতে পারে। যেমন ধরুন, শারীরিক সমস্যা সমাধানে বার্ষিক সরকারি বাজেটের ধারেকাছেও নেই মানসিক সমস্যা সমাধানে সরকারি বাজেটের পরিমাণ। বাজেট বণ্টনে বিষয়টির আনুপাতিক হার বিবেচনা করলেই তো এর অনেকখানি সমাধান সম্ভব। কিন্তু তা হচ্ছে কি? আমরা চিকিৎসকরা এসব বিষয় নিয়ে খুব কমই জানি বা আমাদের কাছে এসব তথ্য খুবই সীমিত পরিমাণে থাকে। সাংবাদিক এর বিশদ তুলে ধরার ক্ষমতা রাখেন, যা সরকারের দৃষ্টিতে আসবে বলে আশা রাখছি। তবে ধারাবাহিক এবং ফলো-আপ নিউজ কাভার করতে হবে।

চিকিৎসকদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষার মানসিকতা ও ভূমিকা রোগীদের রোগমুক্তির ক্ষেত্রে অনেক বড়ো ভূমিকা পালন করে। যেমন- মানসিক সমস্যা সমাধানকল্পে সাইকিয়াট্রিস্ট ও চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীর সমন্বিত উদ্যোগে চিকিৎসা রোগীদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। ধরুন, একজন মানসিক রোগী প্রথমে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে গেলেন। এবার সাইকিয়াট্রিস্ট রোগীর রোগের অবস্থা বিবেচনাপূর্বক ওনাকে কিছু ওষুধ দিলেন এবং উনি মনে করলেন, ওষুধের পাশাপাশি তার কাউন্সেলিং কিংবা সাইকোথেরাপি প্রয়োজন বিধায় উনি একজন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীর কাছে তাকে রেফার করলেন। এবার চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীর কাছে আসার পর উনি কেস হিস্ট্রি নিলেন এবং যথাযথ চিকিৎসা অর্থাৎ সাইকোথেরাপি শুরু করলেন। এ অবস্থায় সবচেয়ে কার্যকর হয় যদি এ দুইজন থেরাপিস্ট (সাইকিয়াট্রিস্ট ও চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী) একই রোগীর ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের কাজটি করেন এবং যুগপৎভাবে চিকিৎসাটি চলিয়ে নিয়ে যান ফলো-আপের মাধ্যমে। সংবাদপত্র এক্ষেত্রে এই কেসটি এবং সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে সফলতার কথা তুলে ধরতে পারে। এতে চিকিৎসকদের যেমন সুনাম বাড়বে, তেমনি রোগীও সুস্থ হয়ে ফিরে যাবেন। চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাও বৃদ্ধি পাবে। তাতে মানসিক চিকিৎসা গ্রহণের প্রতি রোগীদের ভয় দূর হয়ে তারা সাহসী হবেন। রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বোঝাও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে।

বিনোদনমূলক তথ্য ও বিভিন্ন ধরনের পরিবেশনার মাধ্যমেও সংবাদপত্র মানসিক স্বাস্থ্য-সমস্যা সমাধানে অবদান রাখতে পারে। নাটক, সিনেমা, এনিমেটেড কার্টুন (যেমন- মীনা) ইত্যাদি বিষয় অনলাইনে পরিবেশনার মাধ্যমে শিক্ষা ও সচেতনতামূলক উপস্থাপনা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে, যা সামাজিক মূল্যবোধ তৈরিতেও অবদান রাখে। এসব মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরাও সচেতন হতে পারে। সর্বোপরি, সংবাদপত্রে আলোচ্য মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্যগুলোকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন- ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, ইউটিউব প্রভৃতির সঙ্গে সংযুক্ত করে এর বিস্তৃতি ও প্রসারে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।

লেখক: সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট

তথ্যসূত্রঃ

১.https://www.icanotes.com/2018/04/11/ways-mental-illness-is-commonly-misrepresented-in-the-media

২. Anderson M. ‘One flew over the psychiatric unit’: mental illness and the media. Journal of Psychiatric and Mental Health Nursing 2003; 10:297-306.

৩. Hannigan B. Mental health care in the community: An analysis of contemporary public attitudes towards, and public representations of, mental illness. Journal of Mental Health 1999;8(5):431-40.

৪. Pirkis J, Francis C. Mental illness in the news and the information media: a critical review. Mind frame National Media Initiative Mind frame, 2012.

৫. Wahl OF. Stop the presses. Journalistic treatment of mental illness. In: Friedman LD, editor. Cultural sutures. Medicine and media. Durkheim, NC: Duke University Press, 2004:55-69.

৬. Corrigan PW, Powell KJ, Michaels PJ. The effects of news stories on the stigma of mental illness. The Journal of Nervous and Mental Disease 2013;201(3):179-82.

শেয়ার করুনঃ

এখানেই থেমে যাওয়া নয়

আরও যা পড়তে পারেন

বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টিভির চ্যালেঞ্জ, সমস্যা ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশে দুই দশক ধরে গণমাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি ও সংবাদকর্মীদের মধ্যে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

অপরাধবিষয়ক সাংবাদিকতা

জনগণের কাছে সমাজের নানা ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরার মাধ্যমে গণমাধ্যম ‘ওয়াচডগের’ ভূমিকা পালন করে। মানুষের জানার অধিকার বা আগ্রহ থেকে

ক্রীড়া সাংবাদিকতার সেকাল-একাল

দ্দূর জানা যায় বা গুগল-উইকিপিডিয়া ঘেঁটে দেখা যায়, ছাপার অক্ষরে প্রথম দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় সতেরো শতকের শেষদিকে।

সাংবাদিকতায়
হাতে-খড়ি হোক
পিআইবির সাথে

সাংবাদিকতা বিষয়ে ই-লার্নি  কোর্স করতে নিচের বাটনে ক্লিক করুন। বিস্তারিত জানতে ই-মেইল করুন support@pibelearning.gov.bd ঠিকানায়