ঢাকার বাইরে টিভি সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ, বিপদ ও বিপত্তি

আমীন আল রশীদ

ঢাকার বাইরে সাংবাদিকতা এমনিতেই নানা কারণে চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ। সে হিসেবে টেলিভিশন সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ আরও বড়ো।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে যারা স্থানীয় প্রতিনিধি, সংবাদদাতা এবং কিছু ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন, তাঁদের মূল শক্তি হচ্ছে সোর্স বা সূত্র। তাঁরা সবসময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে না পারলেও অন্য সাংবাদিকের কাছ থেকে বা ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ফোনে কল করে তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন লিখে পাঠাতে পারেন। যত বড়ো ঘটনাই হোক, কেবল মোবাইল ফোনে তথ্য নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সংবাদ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।

একজন সাংবাদিক যে প্রতিবেদনটি লেখেন, অনেক ক্ষেত্রেই সেটি কপি-পেস্ট করেন অন্য সাংবাদিক। কেবল প্রতিবেদনটি মেইল করার আগে প্রতিবেদকের নামটি বদলে দেন। এ বিষয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি বা ‘জেন্টেলম্যান অ্যাগ্রিমেন্ট’ থাকে। কমবেশি সবাই এর সুবিধা নেন। তবে এই আদানপ্রদানটি চলে ডে ইভেন্ট বা দিনের ঘটনা সংশ্লিষ্ট সাধারণ খবরের ক্ষেত্রে। যেমনÑ দুর্ঘটনা, বিশেষ ব্যক্তি যেমন- এমপি-মন্ত্রীর অনুষ্ঠান, সরকারের কোনো প্রচারমূলক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা খেলাধুলা। বিশেষ প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে সাধারণত এই আদানপ্রদান হয় না। বিশেষ প্রতিবেদনের আইডিয়া নিয়ে সাংবাদিক নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করেন ঠিকই; লেখেন যে যার মতো।
টেলিভিশন সাংবাদিকতায় কপি-পেস্টের সুযোগ কম। এর মূল কারণ মাইক্রোফোন বা বুম। বিশেষ প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে তো বটেই, দিনের ঘটনার ক্ষেত্রেও।

ধরা যাক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ঝালকাঠি প্রতিনিধি আক্কাস সিকদার কাঁঠালিয়া উপজেলার একটি অনুষ্ঠান কাভার করে এলেন। সেখানে আয়োজকদের বক্তব্যও তিনি তাঁর ক্যামেরা এবং অফিসের মাইক্রোফোন বা বুমে ধারণ করলেন। কিন্তু এনটিভির প্রতিনিধি কে এম সবুজ তাকে বললেন, ‘ভাই ভিডিও ফুটেজটা দিয়েন।’ আক্কাস সিকদার হয়তো সম্পর্কের খাতিরে ভিডিও ফুটেজটি দিলেন। কিন্তু সবুজ যখন ওই সংবাদ এনটিভিতে পাঠালেন, তার কিছুক্ষণ পরই অফিস থেকে তাকে ফোন করে জানতে চাওয়া হবে, ফুটেজে এনটিভির বুম দেখা যাচ্ছে না কেন?

পত্রিকায় এই ভয় কম। কেননা প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কোনো খবর যদি অন্য কোনো পত্রিকার প্রতিনিধি নাম বদলে পাঠিয়ে দেন, সেটি পত্রিকা অফিস বুঝতে পারবে না। তবে এক্ষেত্রেও বিপদ হতে পারে, যদি রিপোর্টের মধ্যে লেখা থাকে, ‘এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন।’ দেখা গেল, সমকালের প্রতিনিধি অসতর্কতার কারণে ওই লাইন থেকে প্রথম আলো শব্দটি ফেলে দেননি। এরকম অভিজ্ঞতা আমার নিজেরও আছে, যখন প্রথম আলোর ঝালকাঠি প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতাম।

স্থানীয় পর্যায়ে টিভি সাংবাদিকতার আরও কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, যেগুলো বুম বা মাইক্রোফোনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। মোটা দাগে কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়।

১. পত্রিকা ও টিভি সাংবাদিকতার পার্থক্য

সংবাদপত্র ও টেলিভিশন সংবাদে মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন প্রথম সারির কোনো পত্রিকায় সাংবাদিকতা করলেই যে তিনি টেলিভিশন রিপোর্টার হিসেবেও খুব ভালো করবেন, এমনটা না-ও হতে পারে। কারণ টেলিভিশন সংবাদ মূলত ম্যাটার অব পিকচার অর্থাৎ ছবিই হচ্ছে টিভি সংবাদের প্রাণ। পত্রিকার সংবাদে যেমন তথ্য ও পরিসংখ্যান গুরুত্বপূর্ণ, টিভির ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টো। এখানে অনেক বেশি তথ্য বা পরিসংখ্যান পরিত্যাজ্য।

টিভিতে অনুসন্ধানী রিপোর্টও খুব কঠিন। কারণ পত্রিকায় যেমন শুধু সূত্র উল্লেখ করেই অনেক বড়ো প্রতিবেদন করা যায়, টিভির ক্ষেত্রে তা কঠিন। কেননা যে কোনো বিষয় প্রতিষ্ঠিত করতে দরকার ছবি এবং সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য। খুব ব্যতিক্রমী কোনো ইস্যুতে ছবি বা বক্তব্য ছাড়া গ্রাফিক্স দিয়ে টিভি রিপোর্ট করা সম্ভব। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই এটি বার্তা বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা মানতে চান না। তারা রিপোর্টারকে চাপ দেন ছবি ও বক্তব্যের জন্য।

পত্রিকা ও টিভির খবরের কাঠামোও এক নয়। পত্রিকায় যেমন ‘ষড় ক’ বা ফাইভ ডব্লিউ ওয়ান এইচ-এর সূত্র মেনে লিখলেই একটি সংবাদ দাঁড়িয়ে যায়, সেখানে টিভির সংবাদে সবসময়ই এই ‘ষড় ক’ আবশ্যক নয়।

পত্রিকার রিপোর্ট লেখা হয় পাঠকের পড়ার জন্য। সেখানে বুঝতে অসুবিধা হলে পাঠকের একই লেখা একাধিকবার পড়ার সুযোগ আছে। কিন্তু টিভি বা সম্প্রচার মাধ্যমের খবর তৈরি করা হয় শিক্ষিত, অশিক্ষিত সব শ্রেণির মানুষের জন্য। অর্থাৎ সম্প্রচারমাধ্যমের খবরের ভাষা হতে হয় এতটাই সহজ ও সাবলীল যে সেখানে অপরিচিত কোনো শব্দ ব্যবহারের সুযোগ নেই। যে কারণে বলা হয়, সম্প্রচারমাধ্যমের খবর হবে, রাইট ফর টেল। অর্থাৎ বলার জন্য লেখা। পড়ার জন্য নয়।

টিভি সংবাদের কাঠামোও আলাদা। সেখানে এমন কিছু শব্দ আছে, যেগুলো পত্রিকার খবরে নেই। পত্রিকার সংবাদে যেটিকে বলা হয় ইন্ট্রো বা সংবাদ-সূচনা, সেখানে টিভির খবরের সূচনা বা ইন্ট্রোকে বলা হয় লিঙ্ক বা ইনভিশন (আইভি)। কোনো খবরে দু-তিন লাইনের একটা আইভি বা লিঙ্ক থাকার পর এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও বক্তব্য বা শট জুড়ে দিলে সেটিকে বলা হয় আইভি শট। আইভির পরে খবরটিকে আরও বিস্তৃত করার জন্য যদি একটা উভ বা আউট অব ভিশন থাকে, তাহলে সেটি উভ শট। এর মানে, টিভি নিউজের সব খবরেই আইভি অবশ্যই থাকতে হবে। প্যাকেজ হলেও সেখানে একটা আইভি বা লিঙ্ক থাকবে, যেটি পড়েন উপস্থাপক।

এগুলো টিভি সংবাদের খুব সাধারণ ধারণা বা এবিসিডি। যারা দীর্ঘদিন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করে হাত পাকিয়েছেন, তাঁরাও যে টিভি সংবাদের এই জার্গন বা পরিভাষাগুলো জানবেন, এমনটা না-ও হতে পারে। আবার টেলিভিশনের জন্য যদি প্যাকেজ করতে হয়, সেখানে আরও বেশি মুনশিয়ানার দাবি রাখে। প্যাকেজের আইভি কতটুকু হবে, সেখানে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য বা শট/সিংক কতটুকু থাকবে, এর দৈর্ঘ্য কতটুকু হওয়া স্ট্যান্ডার্ড এবং সর্বোপরি একটা প্যাকেজের দৈর্ঘ্য কতটুকু হওয়া উচিত- এসব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে ভালো টিভি রিপোর্টার হওয়া কঠিন।

ঢাকার বাইরে যারা সাংবাদিকতা করেন, তাঁদের অধিকাংশই যেহেতু সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করে এই কাজ করেন না, তাই ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ তৈরির এই পার্থক্যটা তাঁদের জানতে হয় চর্চার মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষেরই উচিত তাদের প্রতিনিধিদের জন্য এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। তবে প্রশিক্ষণ বা পড়াশোনার চেয়েও বেশি জরুরি কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও আগ্রহ। যার আগ্রহ বেশি, তিনি নিজ উদ্যোগেই শিখে নেন।

২. ক্যামেরা

ঢাকার বাইরে যারা বিভিন্ন টেলিভিশনের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন, তাঁদের অধিকাংশকেই প্রতিষ্ঠানের তরফে ক্যামেরা দেয়া হয় না। বরং প্রতিনিধিরা নিজেদের পয়সায় হ্যান্ডিক্যাম বা এরকম অল্প দামি ক্যামেরা কিনে কাজ চালান। কেননা টেলিভিশনের হেড অফিসের ক্যামেরাপার্সনরা যেসব ক্যামেরা ব্যবহার করেন, সেগুলোর দাম অনেক। এসব ক্যামেরা কেনা স্থানীয় সাংবাদিকদের জন্য যেমন কঠিন, তেমনি অপ্রয়োজনীয়ও বটে। কেননা বিভাগীয় এবং কয়েকটি বড়ো জেলা শহর ছাড়া সব জেলাতেই টিভি সাংবাদিক একই সঙ্গে ক্যামেরাপার্সন ও রিপোর্টারের কাজ করেন। ফলে বড়ো ক্যামেরা নিয়ে তাঁর পক্ষে যাতায়াত করা কঠিন। অনেক জায়গায় দু-একজন ক্যামেরাপার্সন ঘটনাস্থলে যান এবং সব টিভির সাংবাদিক প্রতিষ্ঠানের লোগো সংবলিত বুম বা মাইক্রোফোন নিয়ে সেখানে হাজির হন। অর্থাৎ টিভি সাংবাদিক যেখানে ১৫ জন, দেখা যাচ্ছে ক্যামেরাপার্সন একজন বা দুজন। অনেক সময় স্থানীয় সাংবাদিক নিজেদের পকেটের পয়সা দিয়ে যে ক্যামেরা কিনলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অফিস থেকে সেই ক্যামেরার দাম দেয়া হয় না। কারণ প্রতিনিধিরা কর্মস্থল পরিবর্তন করেন।

৩. সরাসরি সম্প্রচার

স্থানীয় পর্যায়ে টিভি সাংবাদিকদের আরেকটি বড়ো চ্যালেঞ্জ লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচার। কয়েকটি প্রযুুক্তিতে টিভিতে লাইভ সম্প্রচার করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় প্রযুক্তি ডিএসএনজি (DSNG-Digital Satellite News Gathering), ডিএমএনজি (DMNG-Digital Mobile News Gathering), ব্যাকপ্যাক, ক্যাবল ও মোবাইল ফোন।
ডিএসএনজি সাধারণত বড়ো কোনো ঘটনার জন্য পাঠানো হয়। এটি বেশ ব্যয়বহুল এবং এই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য একটি আলাদা গাড়ির প্রয়োজন হয়। এটি ইন্টারনেটনির্ভর সরাসরি সম্প্রচার প্রযুক্তি।

ডিএমএনজি মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পরিচালিত হয়। এটিও ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের কাছে থাকে না।
ইন্টারনেটনির্ভর সরাসরি সম্প্রচারের সবচেয়ে বেশি ও সহজ প্রযুক্তির নাম ব্যাকপ্যাক। এটি সহজে বহনযোগ্য। ঢাকার বাইরে বড়ো শহরগুলোর অফিসে সাধারণত ব্যাকপ্যাক দেওয়া হয়। এর বাইরে অধিকাংশ প্রতিনিধির কাছেই ব্যাকপ্যাক থাকে না।

ক্যাবলও ব্যয়বহুল। এটি সাধারণত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ব্রডব্যান্ড কানেকশনের মতো আলাদা লাইন টেনে তৈরি করা হয়। যেমন- সুপ্রিমকোর্ট, জাতীয় প্রেস ক্লাব, মতিঝিলসহ যেসব জায়গায় নিয়মিত খবর তৈরি হয়, সেসব জায়গায় টেলিভিশিন কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই লাইন টেনে রাখে এবং যেদিন লাইভ হয়, সেদিন অফিস থেকে ব্রডকাস্ট টিমের লোক গিয়ে সেটি দেখভাল করেন। অনেক সময় নানা কারণে ক্যাবল কাটা পড়ে। ফলে লাইভ বিলম্বিত এবং অনিশ্চিত হয়ে যায়। ঢাকার বাইরেও টেলিভিশনের অফিসহ বিভিন্ন স্থানে এভাবে ক্যাবল লাইন টেনে রাখা যায়।

তবে ইদানীং স্থানীয় পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি লাইভ হচ্ছে স্মার্টফোনের সঙ্গে একটি বিশেষ ডিভাইস সংযুক্ত করে। এটিতে খরচ কম এবং বহনও সহজ। তবে ডিএসনজি, ব্যাকপ্যাক বা ক্যাবলের মতো ছবির মান ভালো নয়। তবে কাজ চালানো যায় এবং কোনো কোনো টেলিভিশনের ঢাকা অফিসের রিপোর্টারও এখন খরচ কমানো এবং ঝামেলা এড়াতে এই প্রযুক্তিতে লাইভ দিতে অভ্যস্ত হচ্ছেন।


৪. নিয়োগ

স্থানীয় পর্যায়ে টিভি সাংবাদিকের একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ নিয়োগপত্র পাওয়া। এটি শুধু টেলিভিশনের ক্ষেত্রে নয়; সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বছরের পর বছর বিনা পয়সায় কাজ করেন অনেক সাংবাদিক। অথচ নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। প্রথম সারির কয়েকটি সংবাদপত্র বাদ দিলে বাকিদের আচরণ এক্ষেত্রে একেবারেই পেশাদারি নয়।

টেলিভিশনের ক্ষেত্রে এটি আরও বড়ো চ্যালেঞ্জ। কেননা পত্রিকায় কপি-পেস্ট করে সংবাদ মেইলে পাঠানো যত সহজ, টিভি সংবাদের ক্ষেত্রে তা এত সহজ নয়। কারণ টিভির খবরের সঙ্গে ছবি দিতে হয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে ছবি সংগ্রহ, সম্পাদনা এবং পাঠানো প্রথমত সময়সাপেক্ষ, পাশাপাশি ব্যয়বহুল।

অনেকেরই এরকম অভিজ্ঞতা আছে যে, মাসের পর মাস কোনো টিভিতে পরীক্ষামূলকভাবে খবর পাঠিয়েছেন অথচ শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এই সময়ে তিনি খবর পাঠাতে গিয়ে যে পয়সা খরচ করেছেন, তা-ও পাননি। ব্যক্তিগতভাবে আমি এরকম একাধিক সাংবাদিককে চিনি, যারা বছরেরও বেশি সময় কোনো কোনো টিভি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে স্থানীয় পর্যায় থেকে খবর পাঠিয়েছেন, নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করেছেন অথচ নিয়োগ পাননি। এমনকি ছবি ও খবর পাঠাতে গিয়ে যে টাকা খরচ হয়েছে, তা-ও পাননি। কারও কারও এরকম অভিজ্ঞতাও আছে যে, মাসের পর মাস খবর পাঠিয়েছেন অথচ হেড অফিসে সাক্ষাৎকারে ডাকা হয়েছে তাকেসহ আরও কয়েকজনকে। দেখা গেল, যিনি দীর্ঘদিন খবর পাঠিয়েছেন, তাঁর বদলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আরেকজনকে।

টেলিভিশনের স্থানীয় প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সবসময়ই পেশাদারিত্ব বা সাংবাদিকের ডেডিকেশনকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়, এমনটা নয়। যোগ্যতা না থাকার পরও অমুকের লোক, তমুকের লোকও নিয়োগ পান। অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পর্ক এখানে বড়ো হয়ে দেখা দেয়।

৫. বেতন ও সততা

স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিককে সব টেলিভিশন ভালো বেতন ও আর্থিক সুবিধা দেয় না। কারও কারও বেতন কাঠামো বেশ ভালো। কেউ কেউ নিয়মিত পেতন পান না। কেউ আবার টাকা পান তাঁর কতগুলো স্টোরি/প্যাকেজ প্রচার হলো তার ওপর ভিত্তি করে। অনেক সময় সাংবাদিককে খবর সংগ্রহের জন্য অনেক দূরে যেতে হয়। কারও কারও মোটরসাইকেল থাকলেও বাকিদের যেতে হয় পাবলিক পরিবহনে। কিন্তু সবাই যাতায়াত বিল পান না। আবার বিল অফিসে জমা দিলেও হিসাব বিভাগ থেকে নানারকম প্রশ্নের মুখে পড়েন।

এর উল্টো চিত্রও আছে। স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকের অনেকের বিরুদ্ধেই আর্থিক অসততার অভিযোগ পাওয়া যায়। বিশেষ করে কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে আয়োজকদের কাছে অনেকে সরাসরি টাকা চান। এরকম অভিযোগ অনেক সময় হেড অফিসেও আসে। তাতে অনেকের চাকরিও চলে যায়।

স্থানীয় পর্যায়ে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করছেন, এরকম একাধিক লোক আমাকে বলেছেন, ‘ভাই যা অবস্থা, এখন তো মানসম্মান নিয়ে কাজ করাই কঠিন।’ এর মানে, এই কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছেন কোনো কোনো সাংবাদিকই। এ সংখ্যাটি হয়তো কম; কিন্তু সাদা জামায় ময়লা লাগলে সেটি অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। ফলে দু-একজন আর্থিক অসততার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে কালিমা লাগে পুরো পেশায়। সাধারণ মানুষ তখন পুরো পেশার মানুষকে খারাপ চোখে দেখতে শুরু করেন। কেননা সাংবাদিকের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তাঁরা বিশ^াস করতে চান, যেহেতু রাজনীতিবিদরা মিথ্যা কথা বলে, পুলিশ ঘুষ খায়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানুষকে হয়রানি করে, ব্যবসায়ীরা ঠকায়, অতএব সাংবাদিক সঠিক কথাটি লিখবেন ও বলবেন। কিন্তু মানুষ যখন সাংবাদিকের কাছ থেকে এই সততা আর বস্তুনিষ্ঠতা পান না, তখন তাঁরা হতাশ হন এবং বলেন, ‘সব সাংবাদিক খারাপ।’

৬. একাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করা

স্থানীয় পর্যায়ে অনেকেই একসঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। আবার অধিকাংশেরই সাংবাদিকতা হচ্ছে দ্বিতীয় পেশা। কারও কারও নেশা। ফলে দেখা যায়, কেউ শিক্ষকতা, ব্যবসা, আইন পেশা বা অন্য কোনো কাজে জড়িত থাকেন মূল কাজ হিসেবে। পাশাপাশি সাংবাদিকতা করেন।

তবে শুধু ঢাকার বাইরে নয়, ঢাকায় যারা গণমাধ্যমের হেড অফিসে কাজ করেন, তাঁদের সম্পর্কেও অনেকের ধারণা যে, এটি তাঁদের দ্বিতীয় কাজ বা সাইড প্রফেশন। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে অনেকবার, ‘সাংবাদিকতার পাশাপাশি আর কী কর …?’ এর মানে, সাংবাদিকতা যে একটি আলাদা পূর্ণাঙ্গ পেশা, সেটি এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ঢাকার বাইরে তো নয়ই। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বিভাগীয় শহরগুলো। কেননা এসব শহরে সব বড়ো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক অফিস থাকে। সেখানে পূর্ণকালীন সাংবাদিক কাজ করেন। এর বাইরে অন্যান্য জেলা পর্যায়ে যারা কাজ করেন, সাংবাদিকতা তাঁদের দ্বিতীয় পেশা হিসেবেই স্বীকৃত।

টেলিভিশনের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে অন্য কোনো কাজ করা কঠিন। কারণ টেলিভিশনে কাজের চাপ বেশি। বিশেষ করে ছবির কারণে। আবার একজন স্থানীয় সাংবাদিক একসঙ্গে একটি বা দুটি বাংলা পত্রিকার পাশাপাশি একটি ইংরেজি পত্রিকায় বা কোনো অনলাইন পত্রিকায় কাজ করতে পারলেও একসঙ্গে দুটি টেলিভিশনের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সুযোগ নেই। অনেকে একটি পত্রিকার পাশাপাশি একটি টিভিতে কাজ করেন। এক্ষেত্রে একটা বড়ো সংকট হয় লেখার স্টাইলে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এরকম একাধিক সাংবাদিককে চিনি, যারা পত্রিকায় ৫০০-১০০০ শব্দের যে প্রতিবেদন পাঠান, হুবহু সেটিই পাঠিয়ে দেন টেলিভিশনে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, টিভি ও পত্রিকার খবরের স্টাইল একেবারেই আলাদা।

৭. খবরের মান

স্থানীয় পর্যায়ে যারা সাংবাদিকতা করেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের লেখার মান বেশ ভালো। আমি এমন অনেককে চিনি, যাদের লেখা বড়ো কোনো সম্পাদনা ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া যায়। বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ সাংবাদিকই যা লিখে পাঠান, তা রিরাইট বা পুনরায় লিখতে হয়। এজন্য তাঁরা নিজে যতটা দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায় প্রতিষ্ঠানের।

যেহেতু টেলিভিশন সংবাদের ফরম্যাট ও স্টাইল আলাদা, সুতরাং এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ের একজন সাংবাদিক ভালো টিভি রিপোর্ট লিখতে পারবেন না, এটিই স্বাভাবিক। আবার সব টিভির নীতি ও স্টাইল এক নয়। দেখা যায়, স্থানীয় প্রতিনিধিদের সবাই এসব নীতি ও স্টাইল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। এ বিষয়ে তাঁদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা থাকে না। এমনকি বছরে একবার যে প্রতিনিধিদের সম্মেলন করা দরকার, অধিকাংশ টিভি স্টেশন তা-ও করে না। ফলে সাংবাদিক যে যার মতো খবর পাঠান এবং তা প্রচারও হয়। মানের উন্নতি হয় না। এ কারণে টেলিভিশনে দৈনিক ঘটনা এবং সাধারণ ইস্যুর বাইরে স্থানীয় পর্যায় থেকে বিশেষ প্রতিবেদন চোখে পড়ে কম। আবার টেলিভিশনে যে ধরনের বিশেষ প্রতিবেদন হওয়া উচিত, তার সঠিক গাইডলাইনও অনেক সময় প্রতিনিধির কাছে থাকে না।

এরকম আরও অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয় স্থানীয় টিভি সাংবাদিককে। আর এসব চ্যালেঞ্জ উত্তরণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেই মূল ভূমিকা নিতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে সাংবাদিকের নিজেদেরও আগ্রহ থাকা দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার প্রতিষ্ঠানের পেশাদারিত্ব। আমাদের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এত বছরেও কেন পেশাদার হয়ে উঠল না বা উঠতে পারল না, সেই প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজা জরুরি।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

শেয়ার করুনঃ

এখানেই থেমে যাওয়া নয়

আরও যা পড়তে পারেন

বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টিভির চ্যালেঞ্জ, সমস্যা ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশে দুই দশক ধরে গণমাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি ও সংবাদকর্মীদের মধ্যে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

অপরাধবিষয়ক সাংবাদিকতা

জনগণের কাছে সমাজের নানা ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরার মাধ্যমে গণমাধ্যম ‘ওয়াচডগের’ ভূমিকা পালন করে। মানুষের জানার অধিকার বা আগ্রহ থেকে

ক্রীড়া সাংবাদিকতার সেকাল-একাল

দ্দূর জানা যায় বা গুগল-উইকিপিডিয়া ঘেঁটে দেখা যায়, ছাপার অক্ষরে প্রথম দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় সতেরো শতকের শেষদিকে।

সাংবাদিকতায়
হাতে-খড়ি হোক
পিআইবির সাথে

সাংবাদিকতা বিষয়ে ই-লার্নি  কোর্স করতে নিচের বাটনে ক্লিক করুন। বিস্তারিত জানতে ই-মেইল করুন support@pibelearning.gov.bd ঠিকানায়